চট্টগ্রামে রাষ্ট্রপক্ষের এক আইনজীবী সাইফুল ইসলামকে হত্যার ঘটনার ১০ দিন পার হয়ে গেল। কোনো সন্দেহ নেই, সে ঘটনার প্রথম কয়েক দিন বা রাত গভীর উৎকণ্ঠা ও উদ্বেগে কাটে গোটা দেশের মানুষের। পরিস্থিতি বিবেচনা করলে যে কেউ স্বীকার করে নেবে যে একটা সাম্প্রদায়িক সহিংসতা সৃষ্টির সব উপাদানই তখন বিরাজ করছিল। নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যেও চরম ধৈর্য ও সহনশীলতার পরিচয় দিয়ে সেই কঠিন সময় আমরা পার করেছি।
তবে বাংলাদেশ নিয়ে ভারতীয় সংবাদমাধ্যম ও হিন্দুত্ববাদী গোষ্ঠীর উসকানি বা আচরণের ফলে একধরনের অনিশ্চয়তাও থেকে যায়। এরই মধ্যে দু-একটি ঘটনা এবং কিছু বিষয় সেটিই ইঙ্গিত করে।
জুলাই অভ্যুত্থানের তিন মাস পরও দেশের সামগ্রিক পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হতে পারেনি। শুরু থেকেই একেক পক্ষ বা গোষ্ঠীর একের পর এক দাবি আদায়ের আন্দোলন, সড়ক অবরোধ, বিক্ষোভ, সংঘর্ষের ঘটনা আমরা দেখে আসছি। এর মধ্যে সংখ্যালঘুদের টানা বিক্ষোভ-সমাবেশে বিপুল জমায়েত চলতেই থাকে।শেখ হাসিনা সরকার পতনের পর তৈরি হওয়া অরাজক পরিস্থিতিতে রাজনৈতিক বা সামাজিক বা সাম্প্রদায়িক বিবিধ কারণে সংখ্যালঘুদের ওপরও আক্রমণের কিছু ঘটনা ঘটে। সেসব ঘটনার সত্যতার পাশাপাশি অতিরঞ্জন ও অপতথ্যের ছড়াছড়িও আমরা দেখি। বিশেষ করে ভারতের কিছু সংবাদমাধ্যম ও টুইটারের প্ল্যাটফর্মগুলোকে বিষয়টি একপ্রকার ‘হাতিয়ার’ বানায়, যা এখনো চলমান আছে। যার পরিপ্রেক্ষিতে ভারতের ত্রিপুরায় বাংলাদেশ মিশনে হামলার ঘটনা ঘটল। এর আগে এখানে ভারতের পতাকা মাড়ানোর একটি ঘটনায় কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে ঢুকে আমাদের পতাকাও পোড়ানো হয়।
শুরুতে ঢাকায় টানা কয়েক দিন হিন্দুদের সমাবেশ ও শাহবাগ অবরোধের পর সরকারের পক্ষ থেকে দাবি পূরণের আশ্বাসের প্রেক্ষিতে মনে করা হয়েছিল কর্মসূচি থেকে সরে আসে সংখ্যালঘুরা।
তবে এরপর ঢাকায় কোনো কর্মসূচি না দিলেও চট্টগ্রামসহ দেশের অন্যান্য অঞ্চলে একের পর এক লক্ষাধিক মানুষের সমাবেশ করে বেশ চমকেই দেয় তারা। সেসব সমাবেশ ঘিরে কিছু সমালোচনাও আসতে থাকে। বিশেষ করে ইসকনের অংশগ্রহণের বিষয়টি এখানে সামনে আসে, বিশ্বজুড়ে ভক্তিবাদী ও সেবামূলক অরাজনৈতিক সংগঠন হিসেবে পরিচিত থাকলেও বাংলাদেশে ইসকন সম্পর্কে একধরনের নেতিবাচক ধারণা আছে। সভা-সমাবেশগুলোয় হিন্দুত্ববাদী ‘জয় শ্রীরাম’ স্লোগান তোলা এবং এসব সমাবেশের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীদের শক্তি সঞ্চয়ের প্রচেষ্টা নিয়ে আলোচনা তৈরি হয়। এমন অভিযোগের সপক্ষে কিছু ছবি-ভিডিও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে।
যাহোক, সংখ্যালঘুদের সেসব সমাবেশের ছবি ও ভিডিও দেশের ভেতরে-বাইরে বাংলাদেশবিরোধী প্রচারণারও অংশ হয়ে যায়। পতিত আওয়ামী শক্তি ও ভারতের হিন্দুত্ববাদী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোর প্রচারণায় বিষয়টি স্পষ্টই প্রতিফলিত হয়। এ
খন দেশজুড়ে নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যে সরকারের জন্য বিষয়টি বাড়তি চাপ তো তৈরি করেই এবং নাগরিক সমাজের কারও কারও মধ্যে এমন প্রশ্ন ওঠে—আওয়ামী লীগ আমলে এত এতখন দেশজুড়ে নাজুক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির মধ্যে সরকারের জন্য বিষয়টি বাড়তি চাপ তো তৈরি করেই এবং নাগরিক সমাজের কারও কারও মধ্যে এমন প্রশ্ন ওঠে—আওয়ামী লীগ আমলে এত এত সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ঘটল, আওয়ামী এমপি-মন্ত্রীরা সংখ্যালঘুদের জায়গা-জমি গিলে খেলেন, তখন কেন তাঁদের বিরুদ্ধে এমন সভা-সমাবেশ বা গণজমায়েত হলো না? তবে যেকোনো কারণেই হোক তখন না পারলেও সংখ্যালঘুরা যে নিজেদের অধিকারের দাবিতে অবশেষে একত্র হতে পেরেছে, এটি অবশ্যই তাৎপর্যপূর্ণ এবং ভবিষ্যতের জন্যও তা উদাহরণ হয়ে থাকবে।
সে সমাবেশগুলোয় কড়া বক্তব্য দেওয়ার মধ্য দিয়ে সংখ্যালঘুদের মধ্যে তুমুল জনপ্রিয় নেতা হয়ে ওঠেন সম্মিলিত সনাতনী জাগরণ জোটের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাস। যাঁর বিরুদ্ধে পতাকা অবমাননার মামলা করেন বিএনপির একজন স্থানীয় নেতা।
বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের পর চট্টগ্রামের নিউমার্কেট চত্বরে একটি লাঠিতে জাতীয় পতাকা বেঁধে দেওয়া হয়। গত ২৫ অক্টোবর লালদীঘির মাঠে সনাতনী জাগরণ মঞ্চের সমাবেশের দিন নিউমার্কেটের ওই পতাকার ওপর গেরুয়া রঙের আরেকটি পতাকা টাঙিয়ে দেওয়া হয়। সেই ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে নানা ধরনের সমালোচনা হয়। তখন পতাকা অবমাননার মামলাটি করা হয়। এখন সেই মামলা নিয়েও সমালোচনা ওঠায় বিএনপি তাঁকে বহিষ্কারও করা হয়।
0 Comments